মানসম্মত শিক্ষা কি? মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার উপায়
মানসম্মত শিক্ষা কি? মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার উপায়মানসম্মত শিক্ষা কি?
যে শিক্ষা বোধসম্পন্ন জ্ঞানের বিকাশ ঘটায় এবং যার মাধ্যমে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রসার লাভ করে সেটাই হলো মানসম্মত শিক্ষা। অর্থাৎ যে শিক্ষা শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তীয়, আবেগিক ও মনপেশিজ তথা সৃজনশীলতার চর্চায় দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে দক্ষ ও যোগ্য করে তোলে, সেই শিক্ষাই হলো মানসম্মত শিক্ষা।
শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিমাণগত মানের উন্নতিতে কেবলমাত্র শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, গুণগতমানের উন্নতি হয়নি। ‘Quality’ শব্দটির অর্থ ‘গুণ’ বা ‘মান”। মানসম্মত শিক্ষা সব ধরণের শিক্ষার্থীর জন্য টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা যা তাদের অর্থনৈতিক, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণকর সমাজ গঠনের উপযোগী করে গড়ে তোলে।
কিভাবে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়?
মানুষ্যত্ব বিকাশে নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার উপায় নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি: মানসম্মত শিক্ষার অগ্রগতিতে শিক্ষকদের যোগ্যতা, দক্ষতা, সার্থক প্রাণবন্ত, প্রাঞ্জল, চমৎকার উপস্থাপনা কৌশল ও প্রয়োগিক গুণাবলির প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত।
শিক্ষকদের অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি: শিক্ষকদের আর্থিক দৈন্যতাও দূর করা।
যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম: মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্ত যোগ্য শিক্ষক, গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য প্রচুর সুযোগ ও মূল্যায়ন পদ্ধতি ইত্যাদি উপাদানগুলো অপরিহার্য।
সকলকে সম্পৃক্তকরণ: মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থাপনা কমিটি, শিক্ষক-অভিভাবকসহ শিক্ষানুরাগী সর্বস্তরের সুধী ও গুণীজনদের শিক্ষার কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে হবে এবং এ জন্য দরকার প্রযুক্তি নির্ভর দক্ষ ও মানসম্মত স্মার্ট শিক্ষক।
উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি: এখানে উল্লিখিত সুপারিশগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য শেখার জন্য সার্বিক দিক থেকে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। এসব সুপারিশের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য উদ্ভাবনি পদক্ষেপ, কর্মকাণ্ডের মান নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতার ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে, নতুবা প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে না।
সহায়ক শিক্ষক নিয়োগ: জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ২০১৮ সালের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩০ অর্জনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। সে লক্ষ্য থেকে আমরা খুব বেশি হয়তো পিছিয়ে নেই। কেননা বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সালে সরকারি প্রাথমিকে এই অনুপাত ছিল ১:৩৯, বেসরকারি প্রাথমিকে ১:২৫, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১:৩৫ ও বেসরকারি মাধ্যমিকে ১:৪২। সহায়ক শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি ইতোমধ্যে কোনো কোনো শিক্ষক নিজ উদ্যোগে প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছেন। সরকার এসব উদ্ভাবনমূলক উদ্যোগ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে একটি আদর্শ মডেল তৈরি ও প্রয়োগ করতে পারে।
গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন: গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যময় আর্থসামাজিক অবস্থা বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন এবং আদর্শ অনুপাতে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও বাড়তি সহায়তা প্রয়োজন কিনা তা ভেবে দেখা জরুরি।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ: মানসম্মত শিক্ষাদানে শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। সরকারের প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিক্ষক প্রশিক্ষণে ভূমিকা পালন করছে সত্য, তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উদ্ভাবন চলছে তা চাক্ষুষ করার সুযোগ রাখা। আমাদের দেশে চিকিৎসা, প্রকৌশল, স্থাপত্য, গবেষণা ইত্যাদি পেশায় জড়িতদের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষকদের জন্য তা তৈরি করতে হবে।
বিদ্যালয়ের দিনসূচি: বিশ্বে বার্ষিক শিক্ষা দিবসের যে মান হিসাবটি আছে (আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী শিক্ষক-শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষ সংযোগের ন্যূনতম সময় বছরে ৯০০-১০০০ ঘণ্টা) তার চেয়ে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা দিবসের সংখ্যা অনেক কম। বার্ষিক শিক্ষা দিবসের সংখ্যা বাড়াতে হলে সারাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রক্রিয়া ও ঋতু অনুযায়ী বিদ্যালয়ের দিনসূচি সাজানো প্রয়োজন। এ নিয়ে বহুদিন ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক আলোচনা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ এখনও নেওয়া হয়নি।
দলগতভাবে শেখার সুযোগ: দলগতভাবে শেখার প্রক্রিয়া উন্নত শিক্ষা পদ্ধতির অপরিহার্য দিক। ব্যবহারিক শিক্ষায় বিশেষ করে এর গুরুত্ব ব্যাপক। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে পাঠ্যবিষয়ের বিভিন্ন অনুবিষয়ের ওপর দলগত কাজ করে। এর মধ্য দিয়ে তাদের বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখা যেমন বিস্তৃত হয়, তেমনি হাতেকলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা কাজ করার মধ্য দিয়ে তারা ওই বিষয়ে বাস্তবানুগ জ্ঞান অর্জন করে। দলগত কাজের মধ্যে দিয়ে তাদের পারস্পরিক বিনিময়ের ক্ষেত্রও প্রসারিত হয়। এমন একটি শিক্ষণ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হলে বর্তমান পাঠক্রম ও শেখার পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে। এতে শিক্ষকদের গুণগত মানের পরিশ্রম অধিক হবে, ফলে তাদের সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাজেট ও প্রকল্প বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি: শিক্ষার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিতে কিছু ক্ষেত্রে উপযুক্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে, আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন আরও উদ্ভাবনমূলক পন্থা ও কৌশল অবলম্বন এবং পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের জন্য কঠোর নজরদারি।
মানউন্নয়নে চাই এখনই উপযুক্ত উদ্যোগ: বিশ্ব ব্যাংকের উল্লিখিত পর্যালোচনাপত্র অনুযায়ী, পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাত্র ২৫ শতাংশের উপযুক্ত পর্যায়ের বাংলা বিষয়ে জ্ঞান এবং মাত্র ৩৩ শতাংশের গণিত বিষয়ে উপযুক্ত জ্ঞান রয়েছে। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৪৪, ৪৪ ও ৩৫ শতাংশের মধ্যে যথাক্রমে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে উপযুক্ত পর্যায়ের জ্ঞান রয়েছে। চিত্রটি যে একেবারেই উৎসাহব্যঞ্জক নয় তা বলা বাহুল্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের ভবিষ্যৎ ১১টি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির একটি বাংলাদেশ। কিন্তু তাদের শঙ্কা শুধুমাত্র শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে অনেক প্রতিশ্রুতির সেই ভবিষ্যৎ মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাই আমাদের উদ্যোগী হতে হবে এবং তা এখনই।
মতামত দিন