বিটিপিটি

এ্যাকশন রিসার্চ কী? এ্যাকশন রিসার্চ কীভাবে করতে হয়?

প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ | Primary Teachers Training 

Action Research in Professional Development

এ্যাকশন রিসার্চ কী? এ্যাকশন রিসার্চ কীভাবে করতে হয়?

কর্মসহায়ক গবেষণা বা এ্যাকশন রিসার্চ (Action Research) কী?

কর্মসহায়ক গবেষণা বা এ্যাকশন রিসার্চের ধারণা দিতে হলে প্রথমত: গবেষণা শব্দটির অর্থ জানা প্রয়োজন। গবেষণা শব্দের বাংলা সমার্থক শব্দ সযত্ন অনুসন্ধান। গবেষণার ইংরেজি হল Research যার প্রতিশব্দ হিসেবে investigation, enquiry, study  ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাধারণভাবে গবেষণা হলো- কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য পদ্ধতিগত উপায়ে নিবিড় বা গভীর অনুসন্ধান। 

কর্মসহায়ক গবেষণা হলো যা কাজের সহায়ক বা যা থেকে কার্য সম্পাদনের নির্দেশনা পাওয়া যায়। কর্ম সম্পাদনে বা উন্নয়নে সহায়তা করে বলে একে কর্মসহায়ক গবেষণা বলা হয়। বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন আনা বা উন্নতি সাধন এই গবেষণার একটি অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া। শ্রেণিশিক্ষক প্রতিদিন যে বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হন তা সমাধানে এই গবেষণা সহায়ক হিসেবে কাজ করে


কর্মসহায়ক গবেষণার সংজ্ঞা:

বিভিন্ন শিক্ষাবিদের প্রদত্ত সংজ্ঞা থেকে বলা যায়কর্মসহায়ক গবেষণা এমন একটি পদ্ধতিগত অনুসন্ধান প্রক্রিয়াযা দ্বারা পেশাদার ব্যক্তি তাদের নিজ কর্মঅবস্থা বা সমস্যা চিহ্নিত করে তা উন্নয়ন বা সমাধানে সচেষ্ট হননিজ উদ্যোগে পদ্ধতিগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে সম্ভাব্য সমাধান বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। 

স্টুয়ার্ট বলেছেন-

“কর্মের উপযোগী গবেষণা হলো এমন একটি ধারাবাহিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ কোনো সামাজিক পরিবেশে তাদের নিজের অবস্থা অনুসন্ধান করে তা উন্নয়নের জন্য স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে”।

প্ল্যানো ক্লার্ক এবং ক্রেসওয়েল (২০১০)-এর মতে-

Research is a process of steps used to collect and analyse information in order to increase our understanding of a topic or issue অর্থাৎ গবেষণা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে বিভিন্ন ধাপে কোনো বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য ওই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয় 

ইলিয়ট (১৯৯১) বলেছেন-

“কর্মসহায়ক গবেষণা পেশাদারদের নির্দিষ্ট জটিলতর মানব পরিবেশে নিজ কার্যাবলির বিশ্লেষণ ও বিচারপূর্বক উন্নয়নের ক্ষমতা প্রদান করে”।


Sample Action Research: Download from here (PDF)


সাধারণত কোনো গবেষণা প্রক্রিয়ায় তিনটি ধাপ জড়িত- 

প্রথমত: অনুসন্ধানের জন্য প্রশ্ন উত্থাপন বা সমস্যা চিহ্নিত করা

দ্বিতীয়ত: প্রশ্নের উত্তর লাভ বা সত্য উদঘাটনের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা এবং 

তৃতীয়ত: প্রশ্নোত্তর বা উদঘাটিত সত্য প্রতিবেদনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা। শিক্ষাবিদদের মতে, গবেষণা প্রক্রিয়াটি নিয়মতান্ত্রিক বা পদ্ধতিগত; এটি এলোমেলো বা অনিয়মিত কোনো প্রক্রিয়া নয়। যখন কোনো শিক্ষা বিষয়ক সমস্যা বা বিষয়বস্তু নিয়ে পদ্ধতিগত ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে অনুসন্ধান করা হয় তখন তা হয় শিক্ষা গবেষণা। 


কর্মসহায়ক গবেষণার ক্ষেত্র | Field of Action Research

শিক্ষা বা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত অনেক ক্ষেত্রেই কর্মসহায়ক গবেষণা প্রয়োগ করা যায়। যেমন-

বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন

শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষার্থী মূল্যায়ন

পেশাগত চর্চার বিকাশ ও উন্নয়ন

শিক্ষণ পদ্ধতি

শিখন কৌশল

শিক্ষার্থী মূল্যায়ন

দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়ন

শ্রেণি/শিখন ব্যবস্থাপনা

প্রশাসনিক বিষয়

 ফলাবর্তন পদ্ধতি

 শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ইত্যাদি

 

কর্মসহায়ক গবেষণার উদ্দেশ্য কি?  

কর্মসহায়ক গবেষণার উদ্দেশ্য হলো- তত্ত¡ (Theory) ও চর্চা (Practice)  সমন্বয় সাধন। মূলত: কর্মসহায়ক গবেষণার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুই ধরনের উদ্দেশ্য অর্জিত হয়। 

প্রথমত: কোন ঘটনা, বিষয় বা পরিস্থিতিকে বিস্তারিতভাবে জানা ও বোঝা। 

দ্বিতীয়ত: উপযুক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো বা সমস্যার সমাধান করা। 

শিক্ষায় কর্মসহায়ক গবেষণার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো, শ্রেণি শিক্ষককে গবেষকের ভমিকায় প্রতিষ্ঠা করা, যাতে সহকর্মীদের সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিজ পেশার ক্রমাগতভাবে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। একজন শিক্ষক তখনই তার শিক্ষার্থীর শিখন মান নিশ্চিত করতে পারেন যখন তিনি একজন গবেষক এবং প্রতিনিয়ত নিজ কার্যের মূল্যায়ন করেন

 

কর্মসহায়ক গবেষণার প্রক্রিয়া বা ধাপ কয়টি ও কী কী?

কর্মসহায়ক গবেষণার প্রক্রিয়া বা ধাপ পাঁচটি। যথা:

ক) সমস্যা চিহ্নিত করা ও সমাধানের জন্য পরিকল্পনা করা

খ) পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা;

গ) পর্যবেক্ষণ করা বা তথ্য সংগ্রহ করা;

ঘ) মূল্যায়ন বা তথ্য বিশ্লেষণ করা; এবং

           ঙ) আত্ম-প্রতিফলন এবং সমাধান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ

 

কার্ট লিউনের মডেল অনুসারে কর্মসহায়ক গবেষণার ধাপ:

সাধারণভাবে Kurt Lewin-কে কর্মসহায়ক গবেষণার ধারণা প্রবর্তনের জনক বলা হয়। কোনো একটি চক্রে চারটি ধাপ অনুসরণ করলেই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা যাবেএটি নিশ্চিত নয়। যদি প্রয়োজন হয় ধাপগুলোর পুনরাবৃত্তি করে গবেষণা কাজ পরিচালনা করতে হবে। এর ফলে সম্পূর্ণ কর্মসহায়ক গবেষণা প্রক্রিয়া একাধিক চক্রে সম্পন্ন হতে পারে




চিত্র: কর্মসহায়ক গবেষণার কার্ট লিউনের মডেল

 

নমুনা এ্যাকশন রিসার্চ দেখুন: Download from here (PDF)

 

ক) সমস্যা চিহ্নিত করা ও সমাধানের জন্য পরিকল্পনা করা

এটি কর্মসহায়ক গবেষণার প্রাথমিক ধাপ। এই ধাপে শ্রেণিশিক্ষক কোন সমস্যা সমাধান করতে চান বা কোন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে চান তা চিহ্নিত করা হয়। 

সমস্যা চিহ্নিত করা: গবেষণার বিষয় বা সমস্যা নির্বাচন করার সময় তা যেন শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর জন্য উপযুক্ত হয়। অর্থাৎ মনে রাখতে হবে, যেন সমস্যাটির সমাধান শিখন বা শিখন প্রক্রিয়ার মানোন্নয়নে গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। একজন শ্রেণিশিক্ষকের মূল লক্ষ্য হলো তার পেশাগত চর্চার (যেমনÑশিখন পদ্ধতি, প্রশ্ন করার কৌশল, প্রশ্ন বা কাজের মান উন্নয়ন ইত্যাদি) উন্নতি সাধন করা এবং শিক্ষার্থীর শিখন মানের উন্নয়ন ঘটানো। কাজেই প্রাথমিক স্তরের একজন শিক্ষক দৈনন্দিন শ্রেণি কার্যাবলি থেকে কোনো একটি বা একাধিক বিষয় নির্বাচন করতে পারেন

 

খ) পরিকল্পনা বাস্তবায়ন

এই ধাপে শিক্ষক তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের যে পরিস্থিতিতে সমাধান বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা করেছেন সে অনুযায়ী শ্রেণিকক্ষে অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করবেন। যেমন-শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের দলগত আলোচনায় নিয়োজিত করার পরিকল্পনা করেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের দলে ভাগ করবেন বা হতে সহায়তা করবেন, দলের বসার স্থান ঠিক করে দেবেন, দলীয় আলোচনার জন্য নির্ধারিত কাজ বুঝিয়ে দেবেন, দলের কাজের ধারা কী হবে সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেবেন, দলীয় কাজ উপস্থাপনার জন্য নির্দেশনা দেবেন, প্রতি ক্ষেত্রে সময় নির্ধারণ করে দেবেন, দলের মধ্যে এবং দলের ভেতরে পারস্পরিক আচরণের নিয়ম জানিয়ে দেবেন

 

গ) তথ্য সংগ্রহ

কর্মসহায়ক গবেষণার পরবর্তী ধাপ হলো পর্যবেক্ষণ, যা প্রকারান্তরে বাস্তবায়ন পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহের ধাপ। কর্মসহায়ক গবেষণা হলো সমস্যা সমাধানের অনুসন্ধান নির্ভর একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য উপযুক্ত কয়েক ধরনের উপকরণ ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সুযোগ এই গবেষণায় রয়েছে। তথ্য সংগ্রহের জন্য এমন এক বা একাধিক কৌশল নির্বাচন করতে হবে, যা দ্বারা বিশ্লেষণ যোগ্য বা কাজের উপযোগী বা ব্যবহারযোগ্য তথ্য পাওয়া যাবে। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে

 

সাধারণভাবে একজন গবেষক দুই ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন- 

১) সংখ্যাগত তথ্য এবং 

২) গুণগত তথ্য। 

 

একজন শিক্ষক প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করলেন, তাঁর শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা নিস্ক্রিয়, এদের উন্নতি করা প্রয়োজন। তিনি মনে করলেন, দলগত আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে সক্রিয় অংশগ্রহণে সাহায্য করা সম্ভব। কাজেই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের দলীয় আলোচনায় নিয়োজিত করে পর্যবেক্ষণ করবেন। শিক্ষার্থীরা দলে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ (যা গবেষণার উদ্দেশ্য) করছে কি না সে সম্পর্কে তথ্য নেবেন। যেমন- শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে কথোপকথনে অংশ নিচ্ছে; কিছু শিক্ষার্থী নীরব, সক্রিয় নয় অথবা কেউ কেউ দলীয় আলোচনাকে অত্যধিক মাত্রায় প্রভাবিত করছে; দলের আলোচনা ঠিকভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। এখানে, কিছু শিক্ষার্থী নীরব, সক্রিয় নয় হলো তথ্য। আর তা সংগ্রহ করা হলো পর্যবেক্ষণ কৌশল প্রয়োগ করে। এই তথ্য এই গবেষণার উপাত্ত হিসেবে ব্যবহৃত হয়

কর্মসহায়ক গবেষণায় বিভিন্ন কৌশল বা পদ্ধতি প্রয়োগ করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সাধারণভাবে একজন কর্মসহায়ক গবেষক একাধিক কৌশলের সমন্বয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন। উলে­খযোগ্য তথ্য সংগ্রহ কৌশলের মধ্যে রয়েছে পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার, প্রশ্নমালা, ফিল্ড নোট, শিক্ষার্থী ডায়েরি, শিক্ষকের রিফ্লেকটিভ ডায়েরি ইত্যাদি

 

ঘ) মূল্যায়ন বা তথ্য বিশ্লেষণ করা

আমরা জানি, কর্মসহায়ক গবেষণায় দুই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। গুণগত তথ্য এবং সংখ্যাগত তথ্য। সুতরাং তথ্য বিশ্লেষণ পদ্ধতিকেও দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো গুণগত তথ্য বিশ্লেষণ এবং অপরটি পরিমাণগত তথ্য বিশ্লেষণ। কর্মসহায়ক গবেষণার অধিকাংশ উপাত্তই গুণগত তথ্য। 

 

আরও পোস্ট দেখুন:

📌 প্রতিফলনমূলক শিখন: উদ্দেশ্য, শিখনের ধারণা, গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য

📌 প্রতিফলনমূলক শিখনের কৌশল

📌 প্রতিফলনমূলক শিখনের কৌশল: লেসন স্টাডি

📌 রিফ্লেক্টিভ জার্নাল কী? কীভাবে রিফ্লেক্টিভ জার্নাল লিখবেন?

📌 প্রতিফলনমূলক শিখন অনুশীলন

📌 প্রতিফলিত শিক্ষক হওয়ার কৌশল: আত্মচর্চা ও মাইন্ডফুলনেস

📌 প্রতিফলনমূলক শিখনের সুবিধা, অসুবিধা, প্রতিবন্ধকতা এবং এর উত্তরণের উপায়

📌 কেইস স্টাডি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই লিংকে প্রেস করুন

📌 কর্মসহায়ক গবেষণা প্রতিবেদন লেখার নিয়ম

📌 অ্যাসাইনমেন্ট (Assignment) সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই লিংকে প্রেস করুন

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।